ঢাকা, শনিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৪, , ১ রবিউল সানি ১৪৪৬
englishwithyeasir@gmail.com +8801633686868
।। জাতিগত নির্মূল ।।

এথনিক ক্লিনজিং (ethnic cleansing) ।। শেখ ফারাবী মান্নান


প্রকাশ: ২৭ মে, ২০২১ ১১:৪৫ পূর্বাহ্ন



Audio

১।

এথনিক ক্লিনজিং (ethnic cleansing) এর সাদামাটা বাংলা তর্জমা হলো জাতিগত নির্মূল। যখন কোন একটি গোষ্ঠী অন্য একটি গোষ্ঠীর সকল সদস্যকে শুধু মাত্র তাদের জাতিগত পরিচয়ের জন্যে মেরে শেষ করে দেয়ার চেষ্টা করে, সেটাই এথনিক ক্লিনজিং। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপরের গণহত্যা, ইরাকে ইয়াজিদিদের ওপর আইসিসের গণহত্যা, রুয়ান্ডায় তুতসীদের ওপরের গণহত্যা এবং ৭১ এর বাংগালীদের ওপর পাকিস্তানিদের গণহত্যা- এসবই এথনিক ক্লিনজিং এর চেষ্টার উদাহরণ। তবে ইতিহাস বলে একটি গোত্র এই এথনিক ক্লিনজিং এর সবচেয়ে বেশী শিকার হয়েছিলো, তারা হলো ইয়াহুদী বা জিউরা। এরা পৃথিবীর অন্যতম সবচেয়ে পুরাতন একেশ্বরবাদের অনুসারী এবং একেবারে মিসরের ফারাওদের যুগ থেকে শুরু করে ২য় বিশ্বযুদ্ধের হলোকাস্ট পর্যন্ত এরা অসংখ্যবার প্রায় নির্মূল হয়ে গিয়েছিলো।

নির্যাতিত একটি গোষ্ঠী ক্ষমতা পেলে তাদের ওপর হওয়া অত্যাচারের ঠিক অনুরূপ আরেকটি ক্ষমতাহীন গোষ্ঠীর ওপর চালাতে পারে, একই ধরনের গণহত্যা এবং সিস্টেমিক অপ্রেশন চালাতে পারে, নিরপরাধ অসহায়ের ওপর পাশবিক আচরণ করতে পারে- এটা ইসরায়েল রাষ্ট্রের ইহুদীরা না থাকলে পৃথিবী হয়তো কল্পনাও করতে পারতো না।

২।

গত ৬ মে থেকে নতুন করে শুরু হওয়া ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত ৩০০ এর বেশী মানুষ আহত এবং ২০ এর বেশী মানুষ প্রাণ হারিয়েছে ( যার মধ্যে আছে ৯ জন শিশু)। ইস্ট জেরুজালেমের শেখ জারাহ ( Sheikh Jarrah) এলাকার ৬ পরিবারকে তাদের বাড়ি থেকে উচ্ছেদের নোটিশ দেয় ইসরায়েল পুলিশ। এর প্রেক্ষিতে তারা কোর্টে (ইসরায়েলী) আবেদন করে। এই আবেদনের রায় হওয়ার কথা ছিলো গত ১০ মে। কানাডিয়ান মুসলিম এক্টিভিস্ট আসোমী জেই তার টুইটে লিখেছেন রায় হওয়ার আগেই গত ১ মে থেকেই ওই ৬ পরিবারের বাড়িতে ইসরায়েলী লোকজন গিয়ে হুমকি দিচ্ছিলো, তাদের বলা হচ্ছিলো রায়ে বাড়ি ছেড়ে দিতে বলবেই, তাই আগেই ছেড়ে দিন আমাদের (ইহুদী নাগরিকরা) কাছে। আমরা না নিলেও অন্য কেউ নেবেই।

এর প্রেক্ষিতে ফিলিস্তিনি আর ইসরায়েলী নাগরিকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষের পরে পুলিশ এসে লাঠি চার্জ করে ( ফিলিস্তিনীদের)। ৮ মে লাইলাতুল কদর ছিলো, মুসলিমদের প্রার্থনার বিশেষ রাত। এই দিন ফিলিস্তিনিরা আল আকসা মসজিদে জমায়েত হয়ে ইসরায়েলের শেখ জারাহ দখলের চেষ্টার প্রতিবাদ করে। পুলিশ গুলি চালায়, ফিলিস্তিনিরা পাথর ছোড়ে। ইসরায়েলী মিলিটারী বিমান হামলা চালায়!

৩।

শেখ জারাহ বসতীর সূচনা ১৯ শতকে। মিসরীয় সুলতান সালাহ আল দীন এর চিকিৎসক শেখ জারাহ নামে গড়ে তোলা এই ক্ষুদ্র নগরে ১৮৬৫ সালে কিছু আরব মুসলিমরা এসে বসবাস শুরু করে। ১৮৭৬ সালে দুটি ইয়াহুদী ট্রাস্টি গ্রুপ আরবদের কাছ থেকে একটি সেকশন কিনে নেয়।

১৯৪৮ সালে (ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষনার পরপরই) আরব ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের সময় শেখ জারাহ অঞ্চল জর্ডান দখল নেয়, ইহুদীরা এখানে থেকে পালিয়ে জেরুজালেমের পূর্ব দিকে গিয়ে আশ্রয় নেয়। জর্ডান এখানে ২৮টি বাড়ি তৈরী করে আরব মুসলিমদের জন্যে। যুদ্ধে ইসরায়েল জেতে, কিন্তু শেখ জারাহ এলাকা জর্ডানের দখলে রয়ে যায়।

৪।

১৯৬৭ সালে আবার আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ হয়। ইতিহাসে এর নাম ৬ দিনের যুদ্ধ, কারন ৬ দিনে ইসরায়েল জর্ডান, সিরিয়া আর মিসরের সম্মিলিত বাহীনিকে হারিয়ে দেয়। এই যুদ্ধের পরে শেখ জারাহ আবার ইসরায়েলের দখলে আসে।

৫।

এই সময় ইসরায়েলী ল্যান্ড এন্ড প্রোপার্টি আইন জারি করা হয়। যে আইন অনুসারে ১৯৪৮ সালের আগে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন অঞ্চলে কোন জমির মালিক ইহুদী হয়ে থাকলে সে সেই জমির মালিকানা দাবী করতে পারবে। কিন্তু এই আইন একই অঞ্চলের আরব মুসলিমদের জন্যে প্রযোজ্য নয়। অর্থাৎ তেল আবিবের কোন অংশের মালিক ১৯৪৮ এর আগে ফিলিস্তিনের কেউ হয়ে থাকলেও সে সেটার দাবী করতে পারবে না।

এই আইনের ভিত্তিতেই জেরুজালেমের বিভিন্ন অংশে ফিলিস্তিনি আরব মুসলিমদের উৎখাত করে ধীরে ধীরে ইসরায়েলী ইহুদী জনগোষ্ঠী দখল নিচ্ছে। এরই সর্বশেষ উদাহরণ শেখ জারাহ।

৬।

ইতিহাস বলে এথনিক ক্লিনজিং এর চেষ্টা যে যে ফ্যাসিস্টরা করেছে তার কেউই সফল হয়নি, উলটো তাদের প্রত্যেকের পতন ঘটেছে। এটা সবচেয়ে বেশী জানে ইয়াহুদীরাই। এজন্যেই হয়তো তারা সবচেয়ে ধীর পদ্ধতিতে। ১৯৪৮ সাল থেকে ইসরায়েলী শক্তির পশ্চিম তীর, রামাল্লা, জেরুজালেম দখলের চেষ্টায় প্রাণ হারিয়েছে হাজার হাজার নিরীহ ফিলিস্তিনি, কিন্তু এই চলমান গণহত্যা কখনোই ব্যপকভাবে আন্তর্জাতিক প্রতিবাদের মুখোমুখি হয়নি।

৭।

একটা বাংলা পোস্ট ফেসবুকে ঘুরছে, যেখানে লেখা 'হিটলার বলেছে আমি ২০ লাখ ইহুদি মেরে কিছু ইহুদী রেখে দিয়েছি যাতে.... '। প্রথমত, হিটলার এমন কিছুই বলেনি। দ্বিতীয়ত, হিটলারকে আদর্শ মেনে সকল ইহুদীর ধ্বংস কামনার মধ্যে একটা বড়সড় মূর্খতা আছে। সেটা এই অংশে ব্যাখ্যা করবোঃ

জায়নিজম বা জায়নবাদ হলো মোটা দাগে ইজরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মতবাদ। অন্যদিকে জুদাইজম হলো ইহুদীধর্ম এবং ইহুদী মতবাদ। জায়নবাদীরা বলে প্রকৃত ইহুদী হতে হলে তাকে অবশ্যই জায়নিজম সমর্থন করতে হবে, অনেকটা যেমন আল কায়েদা, আইসিস বা বোকো হারেম বলে প্রকৃত মুসলমান হতে হলে টেররিজমকে সমর্থন করতে হবে। সব মুসলমান যেমন টেররিস্ট না, তেমনই সব ইহুদীও জায়নিবাদী নয়। যেসব মুসলিমরা 'আইসিসের অপরাধে সব মুসলমানকে দোষী বানানো ঠিক না' লিখে পোস্ট করে সোশাল মিডিয়াতে, তাদেরকেই আবার দেখি হিটলারের নামে নিজেদের মনের কথাটা শেয়ার করতে।

অনেক খ্যাতিবান ইহুদিরাই জায়নবাদের বিপক্ষে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করেছে, যেমন চিন্তাবিদ নোয়াম চমস্কি, টেলিভিশন ব্যাক্তিত্ব জন স্টুয়ার্ট। ম্যারিকান সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে, কিন্তু তিনি ইসরায়েল সরকারের কঠোর সমালোচক। ৯ মের ঘটনার পরে প্রতিবাদ করা প্রথম তিন সিনেটরের তিনি একজন।

জায়নবাদী ইহুদীরা হিটলারের হলোকাস্টে ভয়াবহ নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েছে। নৃশংসভাবে হত্যা এবং হত্যার চেয়েও তীব্র অত্যাচারের মুখোমুখি হয়েছে। তারপর অবশেষে যখন তারা মুক্ত হলো, ঠিক একই স্টাইলে তারা নিরপরাধ ফিলিস্তিনিদের ওপর অত্যাচার শুরু করেছে। আজ যারা ফিলিস্তিনের অসহায়ত্বে অপরাধী ইসরায়েল সরকারের শাস্তি কামনা না করে সকল ইহুদীদের ধ্বংস কামনা করছে, নাৎসী বাহিনীর প্রশংসা করছে, তাদের সাথে জায়নবাদী খুনীদের আসলে কোনো তফাৎ নেই। এথনিক ক্লিনজিং এর সমর্থকেরা সবাই একই ধরনের জানোয়ার, শুধু তাদের ধর্মের লেবাসটা আলাদা।

ফারাবী

১১ মে, ২০২১


   আরও সংবাদ